দুপুরের
এই সময়টা যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা। একরকম
শুন্যতা এসে ভর করে চৈত্রের এই
নিদাঘ দুপুরে। বাইরে
কাঠ ফাটা রোদ্দুর। একটা নিঃসঙ্গ চিল আকাশ জুড়ে পাক দিয়ে যায়। চারদিকটা
কেমন যেন! দূরে কোথাও তৃষ্ণার্ত
কাক কা কা করে ডেকে যাচ্ছে এক টানা একঘেয়ে ভাবে, হয়ত সে খুঁজে পাচ্ছেনা পানযোগ্য কোন
উৎস। মাথার ওপরে ফ্যানটা সেই কখন থেকে বন্ বন্ করে ঘুরছে। ফ্যানের
বাতাসে চুল খানিকটা শুকিয়ে ভেজা তোয়ালে হাতেই মেঘ বেলকনির
রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়ায়। লোহার গ্রিলে হাত রেখে সামনে তাকায় সে। রাস্তায়
ক্র্যাচে ভর দিয়ে ভিখিরিটা আজো সেই একইভাবে গান গেয়ে যাচ্ছে। ঝরে পড়া শিমুলের
ছোটখাট পিরামিড কাল পীচঢালা পথটাকে বর্নিল করে
রেখেছে। তবে বখাটে গাড়িগুলো সেগুলোকে দ্বিধাহীনভাবে পিষ্ট করে
ছুটে যায়। হালকা বাতাসের ছোঁয়ায় বেলকনির এক কোণে দুলে ওঠে অপরাজিতার শীর্ণ লতা,থির থির
করে কেঁপে ওঠে ঘন অথবা হালকা নীল পাপড়িগুলো। দূর
থেকে বাচ্চাদের কোলাহল ভেসে আসে। স্কুল ছুটি হয়েছে হয়তবা। ছেলে সৌম্য’রও বোধহয় স্কুল
থেকে ফেরার সময় হল। তাকে আজ ছেলের পছন্দের খাবার রেডি করতে হবে। সপ্তাহের
অন্য দিনগুলোতে তো পারেনা! তাই
অফিস ছুটির দিনগুলোতে বাচ্চাদের নিজ হাতে খাওয়াতে তার খুব ভাল লাগে। ঘরে সেলফোনটা
তখন থেকে এক নাগাড়ে বেজেই চলেছে। ডাইনিং
টেবিলের ওপরে সেটা পড়ে আছে। মেঘ জানে
কল্টা কার,কোথা থেকে এসেছে,কিন্তু ইচ্ছে
করেই কলটা রিসিভ করছেনা। জীবনের
কঠিন এক সন্ধিক্ষণে সে দাড়িয়ে তবুও যেন আজ ভাবলেশহীন। সে ঠিক করেছে যতই বাজুক না কেন ফোনটা সে আর ধরবে না। দরজার
ওপাশে যে দাড়িয়ে আছে তার কাছে সে যাবে না। নিজের
এই পরিবর্তনে সে খুব অবাক হয়। গত
কয়েক মাসে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা সম্পর্কটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পেরে তার খুব ভাল লাগে। অথচ এই সেদিনও সিন্দাবাদের ভূতের মত তা যেন মোটেও তার
মাথা থেকে সরছিল না। জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে
পেরে নিজেকে খুব সুখী লাগে। সে আসলে এই সংসার–স্বামী–সন্তানদের ভালবাসে। তাদেরকে
ছেড়ে সে কোথাও যাবেনা। যতই ঘাত-প্রতিঘাত আসুক না কেন তবুও কারও কাছেই না। কক্ষনো
না।
মইন আর আকাশের বন্ধুত্ব সেরকম গাঢ় কিছু না হলেও তাকে আবার
হালকাও বলা যাবেনা। আসলে কলেজ
জীবনের ঘুণে ধরা বন্ধুত্ব সময়ের শিকেয় ঝুলতে ঝুলতে এখনও টিকে আছে ধূসর নগরীর মত। মাঝে
মধ্যে ফ্যামিলি প্রোগ্রাম থাকলে দেখা হয় কিংবা হঠাৎ সময়ে অসময়ে ফোনে কথা হয়। তবে ব্যাঙ্কিং এরজন্য অফিসের কাছের ঐ ব্রাঞ্চে গেলে অনেক
সময় মেঘের সঙ্গে তার দেখা হয়েই যায়। মেঘ বন্ধুপত্নি হওয়ায় আকাশ ব্যাঙ্কিং থাকলে তাই সেখানেই
যায়। এতে গ্রাহকের
ভিড় থাকলেও ব্যাঙ্কিংটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায়। অনেক সময় আর ঝামেলা বাঁচে তাতে। আকাশের
বিয়ের বেশীদিন হয়নি, এই চার কিংবা পাচ বছর হবে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে স্বামী-স্ত্রীর
মাঝে সম্পর্কের টানাপড়েন লেগে আছে সেই বিয়ের শুরু থেকেই। বোঝাপড়াটা হচ্ছেনা মোটেই। মেঘের একটা ছেলে স্কুলে ক্লাস
সিক্সে পড়ে। আর মেয়েটা কেবল তিন এ পা দিল।
মইন তার ব্যবসার কাজে প্রায়
সারাদিনই ব্যস্ত থাকে, আর সে যখন ঘরে ফেরে তখন গলির মাথার দারোয়ানটা হয়ত ল্যাম্প
পোস্টে হেলান দিয়ে ঘুম তাড়ানোতে ব্যস্ত। মূলত একঘেয়েমি দূর করা আর অবসর সময়টাকে কাজে
লাগানর জন্যই মেঘের ব্যাংকের চাকুরীতে ঢোকা।
গুলশান-২ আর ১ এর মাঝে তার এই
ব্রাঞ্চটা আকাশের অফিসের খুব কাছে। মাঝে
মধ্যে ব্যাঙ্কিং কাজে তাদের এই দেখা হওয়াটা তাই আসলে অস্বাভাবিক কিছু ছিলনা। আর দশজন সাধারণ গ্রাহকের মত আকাশ কতবার ব্যাঙ্কে এসেছে। আবার
কাজ শেষে স্বাভাবিক ভাবে ফিরেও গেছে। হঠাৎ দু’একবার হাসি ঠাট্টা বা হাল্কা কথা-বার্তা হলেও সম্পর্কটা
বরাবরই শালীনতার গন্ডির মধ্যেই ছিল। কিন্তু
বিপত্তিটা ঘটে প্রায় ন’মাস আগে গত বছরে,সম্ভবত নভেম্বরের শেষ দিকে, হয়ত ২৭ তারিখে
সকালের দিকে ছিল সে মুহূর্তটা। গল্পের শুরুটাও সেদিনই ঘটে।
সেদিনের
সকালটাও আর দশটা দিনের মত বেশ ফুরফুরে ছিল। রোজকার মত মেঘ সেদিনও ছেলের টিফিন রেডি করে স্কুলে পাঠিয়ে নিজে তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নেয়। এরপর কাজের বুয়াকে সারাদিনের
কাজের ফর্দ ধরিয়ে দেয়। মইনও এরমধ্যে রেডি হয়ে নেয়, সে অফিসে যাবার পথে মেঘকে তার
ব্রাঞ্চে নামিয়ে দিবে। মেয়ে তখনো বিছানায়। তার জন্য খাবার রেডি করে সেটা ফ্রিজে
রেখে দেয়। বুয়া পরে গরম করে খাইয়ে দিবে। এরপর নাশতা সেরে স্বামীর সঙ্গে অফিসের
দিকে রওয়ানা দেয়। মইন তাকে ব্রাঞ্চের সামনে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে টান দেয় ১ নাম্বারের
দিকে। ওর অফিস ওদিকেই, বাড্ডা লিঙ্ক রোডে।
সেদিন ব্যাঙ্কে কাজের তেমন ভিড় ছিলনা। সাড়ে
দশটার দিকে স্বাভাবিক বশেই কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে আকাশ। চেক
বইটা হাতে মেঘের কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ায়। খানিকটা ঝুকে সালাম দেয়।
কি
ব্যাপার আকাশ ভাই! ঠোটে লিপস্টিক মেখেছেন নাকি আজকাল পান খাওয়া শুরু করেছেন!
আচমকা মেঘের এরকম ঠাট্টায়
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আকাশ, কিন্তু সামলে নেয় নিজেকে। ভেবে
পায়না কি উত্তর দিবে।
নাহ্। কি যে
বলেন ভাবী!
থাক্। লজ্জায় আর লাল হতে হবেনা। আপনার
জন্য কি করতে পারি বলুন?
ব্যাঙ্কিং সেরে অফিসে
ফিরলেও আকাশের কানে লেগে থাকে ভাবীর দুষ্টামিপূর্ণ কথাগুলো। হাসি পায়। একসময় অবশ্য
কথাগুলো সে ভুলেও যায়।
দু’দিন পরই ঘটে আসল বিপত্তিটা। তবে এটাকে পুরোপুরি বিপত্তি বলা বোধহয় ঠিক হবে না। সেদিন
কি এক কাজে ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট প্রয়োজন হওয়ায় সে ব্যাঙ্কে গিয়েছিল।
ইস্স্ !! আজকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে
আপনাকে। কবে বানালেন স্যুটটা?
এইত, কয়েকদিন হল।
দারুণ মানিয়েছে। আপনার পছন্দগুলো আসলেই
সুন্দর। মাঝে মাঝেই ভাবি.........।
মেঘ বাক্যটা শেষ করেনা।
কাজ শেষে অফিসে ফিরে এলেও মেঘের কথার রেশ পারফিউমের মত তার গায়ে লেগে থাকে। এরপর
থেকে কেন যেন বিভিন্ন সময়ের টুকরো টুকরো স্মৃতি বা হালকা কথা-বার্তাগুলো মাতাল
চিলের মত তার মাথার ভিতরে ঘুরে ফিরে পাক
খায়। মেঘের কথাগুলো চিন্তা-ভাবনার অনেকটা দখল করে রাখে। মেঘের ঐ কথাগুলো কি নিছকই
ঠাট্টা নাকি আসলেই কোন সম্পর্কের সূচনার ইঙ্গিত! সে পরীক্ষা
করে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কিভাবে!
ভিখারিরও ডাকাত হতে
ইচ্ছে করে.....পুর্নেন্দ পত্রীর কোন এক কবিতার এরকম একটা লাইন তাকে সাহসী করে তোলে।
তাই একদিন ডাকাত হওয়ার উদগ্র বাসনায় মেঘকে সে এস.এম.এস করে বসে।
Need
a friend. Will you be!
ছোট এক লাইনের একটা এস.এম.এস,কিন্তু
সেটা পাঠানর পর আগের সমস্ত উত্তেজনা যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় চুপসানো বেলুনের মত।
এক ধরনের ভয়,অবসাদ কিংবা দুশ্চিন্তা এসে ভর করে তার মাঝে। সে ভেবে পায়না কি
করবে। সেকি কোন অপ্রীতিকর ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে! চিন্তায় তার শরীরটা হীম হয়ে আসে। সেদিন
অফিসের কাজে তার আর মন বসেনা। মেজাজটা কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। অফিস শেষে সন্ধ্যায়
বাসায় ফেরার মুহুর্তে তার সব উত্তেজনা আর অপেক্ষার পালা শেষ হয়। অচেনা নাম্বার
থেকে একটা ছোট এস.এম.এস আসে।
Yes.
মেঘের এই নাম্বারটা তার
জানা ছিলনা। সে আনন্দে উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চায় কিন্তু পারেনা। সে জানে সমাজ আর
বাস্তবতা কখনই অঙ্কুরোদগমের অপেক্ষায় থাকা এই সম্পর্ককে মেনে নিবে না। বন্ধুর সঙ্গে
বিশ্বাসঘাতকতা করার অস্বস্তিকর একটা অনুভূতিও এসে গ্রাস করে তাকে। কিন্তু
তা যেন ক্ষণিকের বুদ্বুদ মাত্র! মেঘের
জন্য জেগে ওঠা তীব্র আকর্ষণের কাছে খারাপ লাগা অনুভূতিগুলো মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনা। দু’জন পূর্ণ বয়স্ক মানব–মানবী তাই ক্রমেই তলিয়ে যেতে থাকে নতুন এক সম্পর্কের মাঝে।
মেঘের
ক্ষেত্রে সেদিনের অনুভূতিটা ছিল একটু অন্য রকম। বরাবরের মত সেদিনও অফিসে প্রচুর ব্যস্ততা
ছিল। এমনিতেও মাসের শেষের দিকে ব্যাঙ্কে প্রচন্ড রকমের কাজের চাপ থাকে। কাজের প্রচন্ড
ঝামেলার মাঝে মোবাইলে এস.এম.এস রিসিভ টোনে সে বিরক্ত হয়। তার মুখের অভিব্যক্তিতে
তা’ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কিন্তু পরক্ষণেই সে সেটের দিকে ফিরে তাকায়। হয়ত
সে কৌতূহলের কাছে হার মানে। খানিকটা অবহেলায় সেটটা হাতে নিয়ে এস.এম.এস পড়ে হতবাক হয়ে
যায়। সে যেন অফিসের পারিপার্শ্বিকতা থেকে হঠাৎই আলোকবর্ষ
দূরত্বে সরে যায়। কিন্তু পরক্ষনেই দেয়াল ঘড়ির টুং টাং শব্দে সে বাস্তবতায় ফিরে
আসে। এদিকে সেদিকে তাকায়, যেন সে নিশ্চিত
হতে চাচ্ছে আর কেউ এস.এম.এসটা পড়ে ফেলল কিনা। তার মাথা ঝিম
ঝিম করে ওঠে। ভেবে পায়না তার
এ মুহূর্তে কি করা উচিৎ। হাতের কাজ
ফেলে শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দেয়। কলম ডেস্কের কিনারা ঘেষে গড়িয়ে পড়তে যেয়ে
কি ভেবে যেন
থেমে দাড়ায়। মেঘ একদৃষ্টিতে
সে দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে
এরকম হল কেন! তার জানা মতে সে এমনিতেই মাঝে সাঝে আকাশ ভাইয়ের সঙ্গে ফান করত। তার
মাঝে অন্য কোনরকমের ভাবনা কাজ করেনি। নাকি তার অবচেতন মন আসলেই এরকম কিছু একটা
চাইত। তবে কি মনের অজান্তেই আকাশের প্রতি তার এক ধরনের ভাললাগার অনুভূতি কাজ করছিল!
কিন্তু এটা তো ঠিক না। আকাশকে তার ভাললাগেনা
তা ঠিকনা। কিন্তু
এরকম কিছু সে আসলেই চেয়েছিল কিনা
তা’ নিয়ে সংশয় কাটেনা। তার মাঝে বিভ্রম এসে ভর করে। অফিস শেষের আগে খানিকটা ঘোর লাগা
অনুভূতির মাঝেই সে এস.এম.এস এর উত্তর দেয়।
শুরু হয় সমাজ সংসারে সবার অগোচরে অন্য এক সম্পর্কের সূচনা। একটা নতুন গল্প।
অপরাজিতার নীল পাপড়িতে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে মেঘ
বসে পড়ে বেতের চেয়ারটাতে। আধা ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারের হাতলের ওপরে সরিয়ে রাখে। সে স্মৃতির পাতা ওলটাতে থাকে। আজ
কেন যেন স্মৃতিতে পেয়ে বসেছে তাকে। স্মৃতির
মাছিগুলো বড় বেশী জ্বালাচ্ছে, অবিরত। মনেপরে যায় আকাশকে জড়িয়ে গত কয়েক মাসের টুকরো টুকরো
স্মৃতি যত। সম্পর্কটা বেশীদিনের না হলেও অল্প সময়েই তা বেশ গভীর হয়ে যায়। আপনি
থেকে সম্বোধন এক সময়ে তুমিতে এসে ঠেকে। তুই তোকারিও চলে অনেক সময়ে। কাজের ফাঁকে কিংবা
লাঞ্চ ব্রেকের সময়গুলোতে তাদের মাঝে টেলিফোনে খুনসুটি কিংবা এস.এম.এস চ্যাট চলত। মেঘ প্রতিদিন বাসায়
ফেরার আগে কল হিস্ট্রি আর ম্যাসেজ ডিলিট
করেই তবে বাসায় ফিরত। আসলে সে ধরা না পড়ার জন্য সব সময়ই সতর্ক থেকেছে। হয়ত সেজন্যই
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সমান্তরাল একটা সম্পর্ক নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পেরেছে। তবে
তাদের ডেট বা একান্তে দেখা একবারই ঘটেছিল। যদি সেটাকে আদৌ ডেটের পর্যায়ে ফেলা হয়। সেবার
অফিসের কি একটা কাজে মইনকে এক সপ্তাহের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। আর বুয়াও সেদিন বাচ্চাদের নিয়ে পাশের বিল্ডিঙয়ে তার
বোনের বাসায় জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। কি একটা অজুহাতে সে বাসায় থেকে যায়।
আকাশ অল্প সময়ের জন্য সেসময় তার বাসায় এসেছিল। তারা একান্তে কিছু মুহুর্ত
কাটিয়েছিল। রান্না
ঘর...বেসিন... ডাইনিং স্পেস ...ড্রয়িং রুম ... করিডোর সবখানে লেগে আছে আকাশের
সেদিনের স্পর্শ,টুকরো টুকরো সব স্মৃতি। মেঘ ক্রমেই পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানর মত স্মৃতির খোসা ছাড়াতে
থাকে।
সে যখন রান্নাঘরে আকাশের জন্য চা বানানোয় কিংবা
বেসিনে চায়ের কাপ ধুতে ব্যস্ত তখন আকাশ পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ঘাড়ের ওপর
থেকে খোলা চুল সরিয়ে আকাশ তাতে নাক ডুবিয়ে রেখেছিল। আকাশের ঠোট ছুয়েছিল তার ঘাড়ের
কোমল ত্বক। আকাশ যেন মেঘের চুলের কোঁকড়ানো ঢেউ থেকে শরীরের সব ঘ্রাণ শুষে নিয়ে তার
শরীরে মেখে নিয়েছিল। তার সে আবেগঘন স্পর্শে মেঘ কেঁপে উঠেছিল বারবার,উষ্ণ লাভার
স্রোত বয়ে গিয়েছিল নিউরণ থেকে শরীরের সব কোণে। তার ভিতরে তখন যেন ক্রমাগত উল্কাপাত
ঘটেছিল। অন্যরকম সে অনুভূতি! সেটা আসলে কাউকে বলে বোঝানো যায়না। কিন্তু ওরকম
হয়েছিল সে ঐ একবারই। এরপরেও আকাশ অনেকবার দেখা করতে চেয়েছিল কিন্তু মেঘ রাজী হয়নি।
হয়ত অজানা আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে উঠেছিল কিংবা হয়ত সে আরও গভীরে ডুবে মইনকে ঠকাতে
চায়নি।
আকাশের সঙ্গে এনিয়ে অনেকবার ভুল বোঝা বুঝি,মান-অভিমান হয়েছে। সে অনেকভাবে আকাশকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আকাশ যেন নাছোড়বান্দা। কিছুতেই সে সমস্যাগুলো বুঝতে চায়না। আবেগময় তরুণ তরুণীদের মত তাদের কিছুদিন কথা বলাবলি বন্ধ থাকে। কিন্তু এক সময় কথা বলা শুরু হলে আকাশের অন্যায় আবদারগুলো আবারো শুরু হয় নতুন মাত্রা নিয়ে। আসলে ওর মাথায় একবার যা ঢোকে তা থেকে সে মোটেই বেরিয়ে আসতে পারেনা। সেলুলয়েডের ফিতার মত স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠায় মেঘের কেমন যেন লাগে। সে লাটাইয়ে বেঁধে রাখা মনের সুতোগুলো ছাড়াতে থাকে আর তার স্মৃতিগুলো ঘুড়ি হয়ে উড়ে বেড়ায় ব্যাঙ্ক...পায়ে চলা পথ... রেস্টুরেন্ট...বাসার করিডোর... ড্রইং রুম... ডাইনিং স্পেস...রান্না ঘর সবখানে। মেঘের সব বাঁধা ভেঙ্গে দরজার ওপারে দাড়িয়ে থাকা লোকটার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে। কিন্তু তার মাতৃসত্ত্বা তাকে বাঁধা দেয়। প্রিয় সন্তান আর এই সংসার ছেড়ে তার অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা। অনুশোচনার গভীর নীলে সে ডুবে যায়। পরক্ষনেই সে মনটাকে শক্ত করে। এখন হয়ত ওটাই বেশি জরুরী। মেঘ ভেজা চোখ ওড়নায় মুছে খোলা প্রান্তরের দিকে তাকায়। তার বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হুহু করে বানের জলের মত কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। সে বারান্দার গ্রিল আঁকরে ধরে। সামনের খোলা সবুজ দিগন্তে বাতাসের ওপারে বাতাস-আকাশের ওপারে আকাশ। সেখানে সাদা ছেঁড়া মেঘেরা খেলা করে। পেঁজা তুলার মত মেঘ বাতাসে ভেসে বেড়ায়, হয়ত বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসবে। হয়ত মেঘ আর মেঘের কান্না বৃষ্টি হয়ে নেমে আসবে সহস্র ধারায়। নিঃসঙ্গ চিলটা এখনও পাক দিয়ে যায় আকাশের খোলা প্রান্তে। সোনা রোদে তার বিস্তৃত রুপালী ডানা চিকচিক করে। উদাস দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে মেঘের মনেহয় এখনও সবটা শেষ হয়নি, চাইলে এখনও সময় আছে সবকিছু ঠিক করার। সময় আছে মইনের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাবার,যতটা দূরত্বে সে সরে গিয়েছিল। তোয়ালেটা বারান্দার তারে ভাল করে মেলে দিয়ে ঘরে ঢোকে সে।
পোস্ট ভিউঃ 6