স্পর্শের বাইরে - এক

গল্প ঝরা পাতার গান
স্পর্শের বাইরে - এক

      ‘সাভারে আবারও বাস দুর্ঘটনা,উদ্ধার তৎপরতা চলছে ঢিমেতালে

       খবরটা আজ দেশের প্রায় সব ক’টা সংবাদপত্রে বেরিয়েছে বেশ ফলাও করেদুর্ঘটনার খবরটা অবশ্য নতুন কিছুই না। সবসময় যেমনটা হয়ে  থাকে আরকিযাত্রীবাহী বাসের দুর্ঘটনার খবর বেশ গুরুত্ব দিয়েই পত্রিকাওয়ালারা সাধারণত ছেপে থাকে এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নিসকালের নরম রোদে সবাই চা খেতে খেতে অন্যান্য আর দশটা সাধারণ খবরের মতোই দুর্ঘটনার খবরটায়  চোখ বুলিয়ে নেয় মাত্রতারপর হয়তো কখনওবা মিছিল কিংবা সেমিনার, কিন্তু দু’দিন পরে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে ভুলে যায় সবাইযেন নাগরিক জীবনের অনুসঙ্গ হয়ে গেছেআমরা সবাই যেন এটাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে শিখেছি কিন্তু যার আপনজনের বা যে পরিবারের ক্ষতিটা হয়ে থাকে কিংবা যাদের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিটি দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যুবরণ করে, তারা কি আর সহজে ভুলে যেতে পারে সে স্মৃতি! উত্তরটা বোধহয় নাএধরণের ঘটনা কখনও তাদের জন্য সুখস্মৃতি বয়ে আনে নাতবে আজ যে ঘটনাটা বলছি তা অবশ্য খানিকটা অন্যরকমপুরো ঘটনাটাই আসলে এক দিন আগের। অনেকের কাছে অবশ্য এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! কিন্তু যেটা ঘটেছে সেটাতো আমাকে বলতেই হবেএরপর সেটা বিশ্বাস করা বা না করাটা সম্পূর্ণ পাঠকের ইচ্ছে 

       অন্যান্য দিনের মতো গতকালও অভি ঘুম থেকে উঠেছে বেশ সকালেইএরপর নাস্তার টেবিলে বসার আগে খানিকটা সকালের হাওয়া গায়ে লাগানো ওর অনেক দিনের পুরনো অভ্যাসসেসব সেরে অভি কলেজের উদ্দেশে  বাড়ি থেকে বের হয় কিন্তু সেদিকে না যেয়ে সে মানিকগঞ্জের বাসে চেপে বসে। উদ্দেশ্য অবশ্য খারাপ কিছু নাতারপরও মা শুনলে নির্ঘাত যেতে দিবেনা, তাই কাউকে কিছু না বলেই সেদিকে যাওয়ামা’টার যে হয়েছেটা কি! কিছুতেই একা কোথাও যেতে দিবে না ও যে বড় হয়েছে বা কলেজে পড়ছে মা যেন তা মানতেই চায়না! অথচ ক’দিন আগে ওরই কলেজের বন্ধুরা সবাই সুন্দরবন বেড়িয়ে এলোঅভি কত করে যেতে চাইল কিন্তু মা’র ঐ এক কথা বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাওয়া চলবে না আসলে ছেলে যে একটু ভাবুক প্রকৃতির আর সাধাসিধে ধরনের মা তা ভাল করেই জানেন। আর তা জানেন বলেই উনি ছেলেকে সাধারণত একটু আগলে বা চোখে চোখে রাখতে চান। দিনকাল তো আর ভালো না! যাহোক যেটা বলছিলামধামরাইয়ের কাঁসা শিল্পের ওপরে ক’দিন আগে ও ইন্টারনেটে একটা আর্টিকেল পড়েছিল সেটাই নিজের চোখে দেখে আসার বাসনা আরকি। আর তাছাড়া আজ কলেজে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও ক্লাসও নেইওহ্‌, আগেতো বলাই হয়নিঅভি থাকে ব্যাংক টাউন,সাভারে বাবা-মার সঙ্গে, আর সে পড়ে মিরপুর বাংলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষেও ওর বাবা-মার প্রথম সন্তান আর দ্বিতীয়টি হল ওর চেয়ে দু’বছরের ছোট মুনা ও পড়ে সাভার ক্যান্ট পাবলিক স্কুলে। স্কুলের বাসেই আসা যাওয়া তার। বাবা মোঃ আজিজ সরকার একটা বেসরকারি ব্যাংকের আমিন বাজার শাখায় চাকুরিরত, আর মা হলেন গৃহিণীতা যেটা বলছিলামঅভি ধামরাইয়ের কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার সময়ে মানিকগঞ্জ-গাবতলি রুটের বাস পালকি পরিবহনে উঠেছিলসাভার  পর্যন্ত বাসটা ঠিকঠাকই চলছিল কিন্তু সাভার বাজার পার হওয়ার পরে ড্রাইভারের যে কী হল! একই রুটের আরেকটা বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ব্রীজের রেলিঙ ভেঙ্গে একেবারে নিচের খাদেমুহূর্তেই পানির নিচে যাত্রীসহ বাসটা তলিয়ে যায়তারপর মানুষের আর্ত চীৎকার, বাঁচার প্রবল আকুতি আর বাস থেকে যেকোনো ভাবে বের হবার  নিদারুণ প্রচেষ্টায় কী এক অসম্ভব ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব! অভিও চেষ্টা করেছিল বাসের জানালাটা ভেঙ্গে বের হতেকিন্তু সাঁতার না জানা ফুসফুসটা আসলে পানির নিচে বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারেনিনিমিষেই সময়টা কেমন সাদাকালো স্থিরচিত্র হয়ে যায়ও বোধহয় টেরও পায়না না! সাদা চোখের রেটিনাতে স্বপ্নরা তখন স্থির!    

       অতগুলো মৃতের সারি থেকে খুব কষ্টেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অভি সাঁতারটা সে ভালভাবে জানেনাঅথচ আজ কি অবলীলায় সাঁতরে বাসের বাইরে চলে এলো অভিরাস্তায় উঠে ব্রীজের রেলিংটা ধরে বিষাদ ভরা দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে থাকে নিচে মানুষের জটলার দিকেসেখানে এখন বেশ কর্ম চঞ্চলতা এমনকি রাস্তার ভবঘুরে পাগলটাও  হাত লাগিয়েছে তাতেমৃতদেহ উদ্ধারের তৎপরতা চলছেরাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটির ডগায় বসে দুটো  দাঁড়কাকও দেখছে সে দৃশ্য। একটু পরপর তারে দোল খেয়ে কা কা করে উঠছে বিষণ্ণ কাকদুটোফায়ার সার্ভিসের লোকেরা তখনও এসে পৌঁছেনিতবে সাভার থানা থেকে দু’জন কনস্টেবল এসেছে। তারা গাড়ির নাম্বার প্লেট আর লাশের সারি থেকে ড্রাইভারকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করছে। স্থানীয়রা বসে না থেকে হাত লাগিয়েছে উদ্ধারেডুবুরী চোখ তাদের খুঁজে চলছে কোন বেঁচে থাকা যাত্রীর আশায়কিন্তু তার বদলে একে একে তাদের হাতে উঠে আসছে অনেকগুলো মৃতদেহ শিশু,যুবা,বৃদ্ধ,সব বয়সের-সব ধরনেরকারও পরনে দামী ফুল শার্ট আবার কেউবা শায়িত জীর্ণ মলিন পোশাকে মৃত্যুর শীতল আলিঙ্গনে আজ সবাই একাকার। একেকটা মৃতদেহ যেন হঠাৎ থেমে যাওয়া একেকটা মহাকাব্যঅজস্র স্বপ্ন-আবেগ আর ভালবাসার আধার যেন একেকটাএকটা ছোট শিশুর লাশ কে একজন উদ্ধার করে খালের পাড়ে এনে শুইয়ে দিল। শিশুটির শক্ত হাতের মুঠোয় তখনও ধরা আধখাওয়া কাঠি লজেন্সটাহয়ত বাঁচার আকুতিতে শুকনো কাঠিটাই ছিল তার শেষ অবলম্বন! কিংবা একটা কিশোরীবয়সের সন্ধিঃক্ষণে যার বিয়ে হয়েছিল হয়তবারোগা ফর্সা হাত থেকে মেহেদির রঙ মুছে যায়নি তখনওহাতে ভাঙা কাঁচের চুড়ি আর মাথায় রঙিন ফিতা তারঅথবা ওই সাদা পাঞ্জাবির বুক পকেটে ঝর্ণা কলম গুঁজে থাকা বৃদ্ধটির কথাও বলা যেতে পারেযে হয়তবা জীবন যুদ্ধে পরাজিত কোন এক দরিদ্র স্কুল মাস্টারবাড়িতে যার হয়ত শুকনো উপোসি অনেকগুলো মুখ চেয়ে আছে তার জন্য, তার ফেরার অপেক্ষায়কেমন একটা হাহাকার বুকের ভিতরে ধেয়ে আসেকেন যেন সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা এলোমেলো লাগে অভিরকি এক বিবাগী শূন্যতায় পেয়ে বসে তাকেকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎই মনেপরে যায় মা’র কথা। উদাস দৃষ্টিতে বাসার উদ্দেশে রওনা দেয় অভি ঘটনাস্থল থেকে আর খানিকটা এগোলেই ব্যাংক কলোনি, ওদের বাসাতার উষ্ণ আশ্রয় স্থল, যেখানে মা’র ভীরু চোখ ওর অপেক্ষায় থাকে সবসময়      

       বাসার গেটটা কেন যেন আজও খোলা পড়ে আছেএটা অবশ্যই মুনার কাজমা দেখলে নির্ঘাত রাগারাগি করবেনএকদম খেয়ালি আর আদুরে ওর বোনটা এতো করে বলা হয় তবুও সে গেটটা বন্ধ করতে ভুলে যাবেই যাবে! বারান্দার খাঁচায় পোষা নিঃসঙ্গ ময়নাটা একা খাঁচার ভিতরে নেচে যাচ্ছেআজ কিন্তু অভি বলে ডাকল না ময়নাটা সে একটু অবাক হয়। ড্রয়িং রুমের দরজাটা আধখোলা ছিলবাসায় ঢুকে ও সরাসরি চলে যায় নিজের রুমে ময়লা কাপড় ছাড়তে হবে যে! স্নানটাও সাড়া দরকারদুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই হয়ত মা ডাকাডাকি শুরু করবেসে বাসায় ঢুকেছে ঠিকই কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতাটা যেন একটু অন্যরকম মনেহচ্ছে তার কাছেঅন্যধরণের শিরশিরে একটা অনুভুতি কিন্তু ঘটনাটা অভি ঠিক আঁচ করতে পারছেনাবাসায় মুনার পোষা সাদা বেড়ালটা যেভাবে নিঃশব্দে ঘুড়ে বেড়ায় বাড়িময়, আজ ওর নিজের অবস্থাটাও যেন তেমনি হয়েছেসেও যেন আজ সাদা বেড়ালটা হয়ে গেছেঘরে ঢোকার সময় মা  মনেহল দেখলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না এরকম সাধারণত হয়নাকি জানি কেন! বাবার অফিস বোধহয় আজ বন্ধ এই অবেলায় পাতলা ফতুয়ায় ইজি চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেনপেপারটা বুকের ওপরে ভাঁজ করে রাখা আর মাথার উপরে ফ্যানটা একঘেয়ে ভাবে বন্‌বন্‌ করে ঘুরছেচশমাটা যথারীতি পাশের ছোট টেবিলটায় পরে আছে আড়াআড়ি ভাবেচা’র কাপটা খালি। একটা দিকভ্রান্ত মাছি অনবরত খাবি খাচ্ছে তাতে। বাসাটায় কেমন যেন একটা নিস্তব্ধতাদুপুর গড়াবে বলে। অবশ্য বছরের এই সময়টায় এমনিতেই প্রখর নির্জনতা ছেয়ে থাকে বাইরে খাঁ খাঁ রোদ্দুর ফেটে পড়ছে যেন! বেশ গরম পড়েছে আজদূরে কোথাও তৃষ্ণার্ত কাক অবিরত কা কা করে যাচ্ছে অভি মন খারাপ করে জানালার কাছটাতে এসে দাঁড়ায় বেড়ালটা বোধহয় পর্দার আড়ালে ছিলহঠাৎ লাফিয়ে পালালোওকে দেখে নাকি ইঁদুরের খোঁজে কে জানে! মুনা একবার এসে দরজার পর্দাটা সরিয়ে উকি দিয়ে গেলহয়ত খুনসুটি করার জন্য, কিন্তু মুখে কিছু বলল না ওকে। আজব! মুনা’টা সব সময়ওর পিছনে লেগে থাকে। ওকে না জ্বালালে যেন বোনটার পেটের খাবার ঠিক হজম হয়না। অথচ আজ ও কিছুই বলল নাপাশের ঘরে মা আর মুনা কি নিয়ে যেন মৃদু স্বরে কথা বলছে শোনা যায় আবার ঠিক শোনা যায়না। সম্ভবত বাস দুর্ঘটনার খবরটা মা’কে জানাচ্ছেস্কুলের বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনেছে হয়তবাও আবার গল্প বলায় পটুহয়ত ওটা শুনেই মা টিভিটা চালু করলেনদুপুরের খবর হচ্ছে। টিভিতেও দেখাচ্ছে দুর্ঘটনাটার সচিত্র প্রতিবেদন। উদ্ধার তৎপরতা তখনও চলছে বেশ সজোড়ে। লাশের হিসাব মেলানো যাচ্ছেনা। লোকাল রুটের গাড়িতো! তাই কেউই সঠিক ভাবে বলতে পারছেনা ঠিক কত জন যাত্রী ছিল তা’তেফায়ার সার্ভিসের লোকেরা অবশ্য চেষ্টা করছে তাদের সাধ্য মতোতাদের একজন অফিসার উদ্ধার তৎপরতার উপরে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিলেনকিন্তু সব সময় এসব ক্ষেত্রে যেমনটা হয়ে থাকে আরকিকৌতূহলী দর্শকের চাপে উদ্ধার তৎপরতায় খানিকটা বিঘ্নতা ঘটছে আসলে দেশে বিনোদনের এত অভাব যে মানুষ হাতের কাছে যা পায় তাতেই বিনোদনের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে থাকেমা যেন খানিকটা উদাস হয়ে টিভির পর্দা থেকে মুখ ফিড়িয়ে শাড়ির আঁচলে চিবুকের ঘাম মুছলেন। মা কি তার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন! কি জানি, হয়তবা করছেন!     

       ডাইনিং রুম থেকে প্লেট চামচের টুং টাং শব্দ ভেসে আসছে। বোধহয় খেতে বসেছে সবাইঅভি কান পেতে আছে মায়ের ডাকের অপেক্ষায়। বাবা কি নিয়ে যেন কথা বললেন আর তা’ শুনে মুনা হাসছে। মা’ও যোগ দিলেন সে হাসিতেআশ্চর্য এরা সবাইকি আজ ভুলে গেছে তার কথা! তাকে না ডেকেই কি সুন্দর ভাবে সবাই খেতে বসে গেছেঅভি রাগ করে রান্নাঘর থেকে নিজের প্লেটটা এনে মুনার পাশের চেয়ারটাতে যথারীতি বসে পরেওটা ফাঁকাই ছিল খাবার সময়ে রোজ ওটাতেই যে সে বসে থাকে! বাবা মনেহয় দু’বার তাকালেন দেয়াল ঘড়িটার দিকে। মুনাও যেন একবার কি ভেবে এ পাশে ফিরে তাকালো কিন্তু কিছু বলল নামা খেয়ে যাচ্ছেন চুপচাপবেড়ালটা মুনার পায়ের কাছে লেপটে আছে বরাবরের মতোএকবার গলা তুলে অভির দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ করল কিন্তু পরক্ষনেই চুপ হয়ে গেল বেড়ালটাআচ্ছা এরা সবাই বোবা হয়ে গেল নাকি, সবাই মিলে ওর সঙ্গে কথা না বলার কঠিন পণ করেছে যেনমাকে আস্তে করে বলল প্লেটে খাবার তুলে দিতে। মা বোধহয় ডাকটা শুনতে পাননিআবারও বলল অভি, কিন্তু মা কিছু বলছেন না আবার প্লেটে খাবারও তুলে দিচ্ছেন নাকি আশ্চর্য এরা সবাই আজ ওর সঙ্গে এরকম করছে কেন! ও নাহয় বাসার কাউকে না বলেই ধামরাই গিয়েছিল কিন্তু সেজন্য এরা সবাই ওর সঙ্গে এরকম করবে! ওতো পরে সব জানাতোই! ছবিও তুলেছে এক গাদা সবাইকে দেখাবে বলে। ধুর্‌! ভাত’ই খাবেনা আজ। রাগ করে উঠে পড়ে চেয়ার থেকে। অভি গট্‌গট করে হেঁটে বাসার ছাদে চলে যায়।     

     এদিকটাতে এখনো সেভাবে দালান কোঠা গড়ে ওঠেনি। অনায়াসে দৃষ্টিটা ফসলের মাঠ ছুঁয়ে বহুদূর পর্যন্ত চলে যায়অভি সে দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেএরপর তার দৃষ্টিটা এসে থম্‌কে দাঁড়ায় পেয়ারা গাছের ডালে সদ্য  বোনা টুনটুনির বাসাটাতে। বাজার থেকে খালি ড্রাম কিনে এনে ছাদে পেয়ারার গাছটা ও নিজেই লাগিয়েছিলতাতে ডাঁসা পেয়ারাও ধরেছে বেশ ক’টাকিন্তু টুনটুনির বাসাটা এর আগে অভি খেয়াল করেনিপেয়ারার ডাল থেকে নেমে আসা লালচে পিঁপড়ের সাড়িটা অনুসরণ করে নিজের পায়ের দিকে চোখ পড়তেই অভি চম্‌কে উঠেপ্রখর সূর্যটা মাথার উপরে মগজ গলিয়ে দিচ্ছে আজ অথচ ওর শরীরের ছায়াটা কোথাও চোখে পড়ছেনাআসে পাশে হতভম্ব হয়ে তাকালোনা, সবই ঠিক আছে শুধু ওর ছায়াটা ছাড়া। ওটা নেই ওর সঙ্গে। অভি কি করবে ভেবে পায়না     

        অভি নীচে নেমে ওর রুমের ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায় নাসেখানেও কেবলই নিঃসীম শুন্যতাকিছুই দেখা যায়না তা’তে। অভি ওর প্রিয় শরীরটাকে খুঁজে না পেয়ে প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পরেযে শরীরটা ওর আত্মার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল গত আঠারোটি বছর ধরে সে আর নেই ওর সঙ্গেঅভি চীৎকার করে কেঁদে ওঠেহয়ত সে কান্না প্রতিধ্বনিত হয় চার দেয়ালের ঘর ছাপিয়ে বাইরে আরও কোথাও, কিন্তু তা’ কেউ কোনও দিন শুনতে পায়না। ডাইনিং রুম থেকে ভেসে আসে টুং টাং চামচের শব্দ, ফিস ফাস কথার ধ্বনি আর সে সঙ্গে হালকা হাসির ছর্‌রাসে যেন অতি চেনা এই পৃথিবী, প্রিয়জন বা এই পরিবারের আর কেউ না। সে এখানে অনাহূত আগন্তক মাত্রহঠাৎ করেই যেন বদলে যায় সবকিছু একরাশ তীব্র অভিমান এসে গ্রাস করে ওকে। এত যে পরিচিত পরিমণ্ডল তা’ কেমন করে যেন অতি সহজেই দূরে সরে গেলস্পর্শের বাইরে সবাই। এমন কেন হয় অভি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেএমনকি তার কান্নাও স্পর্শ করেনা কাউকে, মা’কেও নাতাহলে এই অতি আপন জন,চেনা মুখ, পরিচিত পরিমণ্ডল,আবেগ,ভালোবাসা এসব তাহলে কিসের জন্য? কেন এই মায়া? অভি এসবের উত্তর খুঁজে পায়না। শুধু বুঝতে পারে তার চলে যাবার সময় হয়েছেএখানে সে এখন অযাচিত। মৃতদের এখানে থাকতে নেই। সে এখন শুধুই সাদাকালো স্মৃতি মাত্র কিংবা হারিয়ে যাওয়া কোন খাতা। সে ঘরের চারপাশটায় তাকায়াথরুমে বেসিনের উপরে টুথপেস্ট, ব্রাশ,প্রিয় আফটার শেভ লোশন সবই হয়ত কিছু কাল পরে থাকবে, তারপর একদিন কালের আবর্তে হারিয়ে যাবেআসলে সেটাই হয়ত কঠিন বাস্তবতা! ঘরের কোনে হেলান দিয়ে রাখা গীটারটাতেও ধুলো জমে যাবে, তার গুলোও ছিড়ে যাবে একদিন। তাতে আর কোনদিন টুং টাং শোনা যাবেনাবইয়ের তাক’টাও একদিন ঘুণে পোকায় ঝাঁজরা হবে, ডায়েরীর পাতাগুলোও খসে পড়বে ধুসর পলেস্তরার মতো। কাঁচের জারে রাখা মানিপ্ল্যান্টটা জানালার কাছে বেড়ে উঠছে বেশ লক্‌লকিয়ে। কতদূর বেড়ে উঠবে ওটা? ছাদটা ছুঁতে পারবে কি? জানা হলনা। ঘরের কোনে নিভৃতে রাখা ডেস্কটপ কম্পিউটার-মাউস-কী প্যাড। কার আঙ্গুলের স্পর্শে ওগুলো আবার আন্দোলিত হবে, জানা হবেনাওর ফেস বুক কিংবা ইয়াহু আইডি টার কি হবে, জানা হলনা। ক্লাসে সামনের সারির বেঞ্চে যে মেয়েটা সুযোগ পেলেই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে থাকত, তাকে তো কিছু বলা হলনাসে হয়ত তাকিয়ে থাকতে থাকতে একদিন ঠিকই খুঁজে পেতে নেবে অন্য কাউকে! গরীব ছেলেটা, সামাদ ২০০ টাকা ধার চেয়েছিল বই কিনবে বলে, দেয়া হলনা। কতো কিছুই যে করার বাকী থেকে গেল! কেউ হয়ত জানলোও নাআচ্ছা মানুষের জীবন এতটা ছোট কেন! অভি পড়ার টেবিলে রাখা ওর দু’বছর বয়সের ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেতারপর বেড়িয়ে যায় ঘর থেকেমুনার পোষা বেড়ালটার মতো নিঃশব্দে এ ঘর সে ঘর ঘুড়ে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ায় আবারও। সবার খাওয়া শেষ পর্যায়েএকে একে বাবা-মা-বোন সবার মুখের দিকে তাকায়সে পরম মায়ায় সবার মুখের অভিব্যক্তি পড়ার চেষ্টা করেমুনা’টার সঙ্গে আর খুনসুটি করা হলনা কিংবা মায়ের কাছে নতুন কিছু খাওয়ার আব্দার। বাবার পাঞ্জাবীর পকেটের টাকাগুলোও আর হয়ত খোয়া যাবেনাফেলে আসা স্মৃতিতে পেয়ে বসে অভিকে। হঠাৎ তার শরীরে কার ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করে যেন, চম্‌কে ওঠে সে। ওহ্‌! না,তেমন কিছুনা এই মাত্র খুঁজে পাওয়া গেছে ওর মৃত শরীরটা। বাসের ২৬ নাম্বার সীটে ওটা উপুর হয়ে পড়ে ছিল ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা ওর মৃতদেহটা তুলে সাজিয়ে রাখে নাম না জানা আর সব লাশের পাশে। হয়ত তার মৃতদেহটা আজ সন্ধ্যার টিভির খবরে দেখানো হবে কিংবা কাল দেশের জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় থাকবে তার ছবি। কে জানে। কি আর হবে ওসব ভেবেসে শুধু জানে তাকে যেতে হবে বহু দূর, অনিশ্চিত সে যাত্রা! সংসারের মায়া কাটিয়ে দরজার বাইরে পা বাড়ায় অভি কিংবা অভির আত্মা।   

   

 

 

 



পোস্ট ভিউঃ 259

আপনার মন্তব্য লিখুন